ভারতপথিক রামমোহন | রাজা রামমোহন রায় জীবনী রচনা

রাজা রামমোহন রায় প্রবন্ধ রচনা pdf | রাজা রামমোহন রায় জীবনী বাংলা pdf | ভারতপথিক রামমোহন

আজকে তোমাদের সাথে ভারতপথিক রামমোহন রায় এর জীবনী সংক্রান্ত রচনা শেয়ার করা হল, যেটি তোমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সহায়তা করবে এবং প্রয়োজনে সংগ্রহ করে নিবে।

ভারতপথিক রামমোহন

রামমোহন শুধু বঙ্গসমাজেরই নয়, সমগ্র আধুনিক ভারতবর্ষের স্রষ্টা। তিনি ভারতবর্ষের আধুনিক ভাব-ভাবনা, চিন্তা-চেতনা এবং বুদ্ধি-বিবেকের মহান উদ্বোধক। সমগ্র ভারতবর্ষ যখন মধ্যযুগীয় বর্বরতা ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত, যখন অজগর-ঘুমে তার চিত্তলোক ছিল সুপ্ত, তখন যিনি এই বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে সমগ্র ভারতবর্ষকে প্রথম জানালেন নব-জাগরণের আহ্বান, শোনালেন নব-উত্থানের উদাত্ত বাণী, তিনি মহাত্মা রামমোহন। তাই তিনি আধুনিক ভারতবর্ষের প্রথম জাগ্রত ও যুগপ্রবর্তক মহাপুরুষ।

জন্ম, বংশ-পরিচয় ও শৈশব-শিক্ষা: ইংরেজি ১৭৭২ সাল। হুগলি জেলার রাধানগর গ্রাম। পিতা-রামকান্ত রায়। মাতা-তারিণী দেবী। কুল-পদবি- বন্দ্যোপাধ্যায়। রায়-প্রাপ্ত উপাধি। সন্নিহিত গ্রাম পালপাড়ার নন্দকুমার বিদ্যালংকার (হরিহরানন্দ তীর্থস্বামী) অতি কৈশোরেই রামমোহনের মনে আধ্যাত্মিকতার বীজ বপন করেন। মাত্র পনেরো বছর বয়েসেই তিনি গৃহত্যাগ করে পৃথিবীর সুদূর প্রদেশগুলিতে পর্যটন করেন।

কর্মজীবন: ইংরেজি ১৮০৩ সাল। তিনি দু'মাসের জন্যে কালেক্টর উডফোর্ডের দেওয়ান হিসেবে যশোহরে কাজ করেন। কিছুদিন পরে মুর্শিদাবাদ থেকে আরবি ও ফারসি ভাষায় তাঁর 'তুহফাৎ-উল-মুবাহহিদ্দীন' প্রকাশিত হয়। তারপর ১৮০৫ সাল থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত তিনি সিবিলিয়ান ডিগবির দেওয়ান-রূপে নিযুক্ত ছিলেন। ইংরেজ প্রশাসকের কর্মচারী হলেও তিনি কখনো আত্মমর্যাদাবোধ বিসর্জন দেননি।

ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদান: ১৮১৪ সাল থেকে তিনি কলকাতায় স্থায়ীরূপে বসবাস করেন। দেশি-বিদেশি বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি সমবেত হন তাঁর উদার চিন্তাধারা এবং প্রবল ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে। ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-চিন্তায় এই সময় তাঁর জ্ঞান ও বিশ্বাসের উজ্জ্বল প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। এই সময়ে তাঁর প্রথম এবং প্রধান কাজ হল ভাষ্যসহ বেদান্ত ও উপনিষদসমূহের বঙ্গানুবাদ। তিনিই বাংলা ভাষায় বেদান্তের প্রথম ভাষ্যকার। বৈদান্তিক একেশ্বরের উপাসনার পথ দেখাতে তিনি নিজ গৃহে ১৮১৫ সালে স্থাপন করেন 'আত্মীয় সভা'। এই 'আত্মীয় সভা' ১৮২৮ সালে 'ব্রাহ্মসমাজে'র রূপ গ্রহণ করে। ১৮৩০ সালে ব্রাহ্মসমাজের নিজস্ব ভবন নির্মিত হয়। সেখানে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি-সকল সম্প্রদায়ের মানুষের উপাসনা করবার অধিকার ছিল। 'ব্রাহ্মণ সেবধি' এবং 'সসম্বাঙ্গ কৌমুদি' পত্রিকা-দুটি তাঁর বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসার উজ্জ্বল নিদর্শন।

সতীদাহ-নিবারণ: বাস্তবিকই, মৃত্যু-পরিকীর্ণ ভাগীরথীর উভয় তীরের বহ্নিমান চিতাশয্যার অগ্নিশিখায় রামমোহন প্রত্যক্ষ করলেন মধ্যযুগীয় বর্বরতায় হৃদয়-বিদারক বিভীষিকা। প্রেত-পরিকীর্ণ সেই নিশীথের শ্মশানে তিনি 'মা ভৈঃ' বাণী উচ্চারণ করে 'সতীদাহ' প্রথা বিলুপ্ত করবার মহান ব্রতে অগ্রসর হলেন। তিনি দেখালেন, হিন্দুশাস্ত্রে কোথাও সহমরণের নির্দেশ নেই। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৮২৯ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক সতীদাহকে বিধি-বহির্ভূত বলে ঘোষণা করেন। এতদিনে মহাশ্মশানের চিতাশয্যা থেকে উঠে দাঁড়াল আধুনিক ভারতবর্ষ।

বিলেত যাত্রা ও জীবনাবসান: ১৮৩০ সালে দিল্লির বাদশাহ তাঁকে 'রাজা' উপাধিতে ভূষিত করে তাঁর বিশেষ দূতরূপে বিলেতে প্রেরণ করেন। বিলেতে তিনি বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিশিষ্ট বৈদেশিক দূতরূপে সম্মানিত হন। ১৮৩৩ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর বিলেতের ব্রিস্টলে ঘটে তাঁর জীবনাবসান।

আরও পড়ুন: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনী

উপসংহার: যে পবিত্র হোমাগ্নি বহন করে আর্যরা ভারতবর্ষে একদা প্রবেশ করেছিল, একেশ্বরবাদের আলোকে প্রাচীন ভারতবর্ষ আলোকিত হয়েছিল, কালক্রমে তাকে গ্রাস করে নানা কুসংস্কারের কালিমা। মানুষে-মানুষে ভেদ-ব্যবধান হয়ে ওঠে গগনচুম্বী। কিন্তু ভেদ-ব্যবধানের পথ ভারতবর্ষের পথ নয়, ভারতবর্ষের পথ মিলনের পথ, ঐক্যের পথ। সেই লুপ্ত ভারত-পথের প্রথম সন্ধান পান মহাত্মা কবির। লোকাচার ও দেশাচারের জীর্ণ কুসংস্কারের ভস্মরাশির অপসারিত করে একেশ্বরবাদের প্রতিষ্ঠার মধ্যস্থতায় সেই ভারত-পথের পুনরাবিষ্কার করলেন ভারতপথিক রামমোহন।

Post a Comment